প্লাস্টিক খেকো সুপার এনজাইম তৈরী করলেন বিজ্ঞানীরা!

প্রায় কর্মজীবি মানুষের দিন শুরু হয় রেস্টুরেন্টে এক কাপ চা কিংবা কফি পানের মাধ্যমে। রেস্টুরেন্টে চা-কফি পরিবেশন করা হয় ওয়ানটাইম প্লাস্টিকের সাহায্যে। কারণ ওয়ানটাইম প্লাস্টিকের মূল্য কম, একবার ব্যবহার করে ফেলে দেওয়া যায়, ধোয়ামোছার সমস্যা নেই। সবক্ষেত্রেই  ওয়ানটাইম প্লাস্টিকের ব্যবহার করা মানবজাতির একধরনের নেশা হয়ে দাড়িয়েছে। সকালের শুরু থেকে গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠানে ওয়ানটাইম প্লাস্টিকের রমরমা ব্যবহার।

আরও আছে গৃহস্থালির কাজে ব্যবহৃত নানা ধরনের প্লাস্টিক ও পানির বোতল, স্ট্র, ফুড প্যাকেজিং এর মতো single use  plastic। প্রয়োজন শেষে এসব প্লাস্টিক আমরা ফেলে দিই যত্রতত্র। যার ফলে মাটির নিচে চাপা পড়া কিংবা সাগরে ভাসতে থাকাই হয় এদের শেষ পরিণতি।

আসলেই কি তা? প্লাস্টিক রিসাইকেল বা পুনরায় ব্যবহার উপযোগী করা অনেক কষ্টকর এবং প্রায় অসম্ভব। প্লাস্টিক প্রাকৃতিকভাবে ডিগ্রেড বা মাটির সাথে মিশে না বললেই চলে। প্লাস্টিক মাটির সাথে মিশতে প্রায় ৪০০ বছরেরও বেশী সময় নেয়। প্লাস্টিক পরিবেশে মাটি দূষণ, পানি দূষণ, বায়ুদূষণ, বাস্তুতন্ত্রের সমস্যা সৃষ্টি সহ আরও ভয়াবহ ক্ষতি করে থাকে। এছাড়াও প্লাস্টিক মাইক্রোপ্লাস্টিক, ন্যানোপ্লাস্টিক হিসেবে নানাভাবে প্রাণীদেহে প্রবেশ করছে। যা প্রাণীর রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থায়(immune system), পরিপাক তন্ত্রে, স্নায়ু তন্ত্রে ভয়াবহ প্রভাব ফেলে ও স্বাস্থ্যঝুঁকি সৃষ্টি করে।

(বর্তমানে প্লাস্টিক দূষণের অন্যতম কারণ Single use plastic এর অত্যাধিক ব্যবহার; সোর্সঃ intellinews.com)

বর্তমানে প্লাস্টিক সমস্যা একধরনের বৈশ্বিক সমস্যায় পরিণত হয়েছে। সারাবিশ্বের গবেষকরা প্লাস্টিক সমস্যা সমাধানের জন্য করে যাচ্ছেন নিরলস গবেষণা। এ পর্যন্ত বিভিন্ন গবেষক খুঁজে পেয়েছেন প্লাস্টিক খেকো ব্যাকটেরিয়া, প্লাস্টিক খেকো ফাঙ্গাস, প্লাস্টিক খেকো পোকার সন্ধান এবং মাইক্রোপ্লাস্টিক ও ন্যানোপ্লাস্টিক সমস্যা সমাধানের পথ। তবে এই প্রথমবারের মতো বিজ্ঞানীরা একটি প্লাস্টিক খেকো ব্যাকটেরিয়ার এনজাইম কে ইঞ্জিনিয়ারিং করে সুপার এনজাইমের সৃষ্টি করেছেন যা আগের চেয়ে অনেক বেশী দ্রুত গতিতে প্লাস্টিক রিসাইকেল করবে। নিঃসন্দেহে এ আবিস্কার রিসাইক্লিং খাতে নতুন দিগন্তের সূচনা করেছে।
এবার জেনে নেওয়া যাক এত এত প্লাস্টিক সম্পর্কিত উদ্ভাবনের মাঝে নতুনভাবে এ উদ্ভাবনের প্রয়োজনীয়তা কি ও এর নেপথ্যে মূল কাহিনী কি!
অন্যসব ময়লা-আবর্জনার মতো প্লাস্টিক পঁচে-গলে মাটিতে মিশে যায় না, বরং টিকে থাকে শত শত বছর। আবার সব প্লাস্টিক একইরকম না, প্লাস্টিকের রয়েছে বিভিন্ন ধরন। কিছু প্লাস্টিক রিসাইকেল করা যায়, আবার কিছু প্লাস্টিক রিসাইকেল করা খুব কঠিন, প্রায় অসম্ভব।
বর্তমানে রিসাইকল অযোগ্য প্লাস্টিক হিসেবে দেখা হয় বিভিন্ন single use প্লাস্টিককে, যেমনঃপানীয়ের বোতল। এসব পানীয়ের বোতল তৈরী হয় PET (Polyethylene Terephthalate) নামক এক ধরনের থার্মোপ্লাস্টিক থেকে। PET কে বলা হয় বিভিন্ন কার্বনেটেড পানীয় (সেভেন আপ, কোকা কোলা ইত্যাদি) বোতল তৈরীর আদর্শ উপাদান।
কারণ এ প্লাস্টিকের চাপ সহ্য করার ক্ষমতা খুব ভালো। PET ওয়ানটাইম প্লাস্টিক, পলিয়েস্টার কাপড়ের আঁশে ও সিঙ্গেল ইউজ প্লাস্টিকে থাকে। PET রিসাইকেল করা যায়, কিন্তু ততটা কার্যকরভাবে না। বর্তমানে PET রিসাইকেলের একটি প্রচলিত প্রক্রিয়া হলো বিভিন্ন রঙের প্লাস্টিকের বোতলকে তাপ প্রয়োগে মেল্টিং বা গলিয়ে ফেলা , এরপর যে ধূসর ও কালো বর্ণের প্লাস্টিক উৎপন্ন হয়, তা নতুন প্লাস্টিক উৎপাদনে ব্যবহার করা। তবে রিসাইকেলকৃত এসব প্লাস্টিক নতুন প্লাস্টিক উৎপাদনে ব্যবহারের জন্য অতটা আকর্ষণীয় নয়। আরও দেখা যায় রিসাইকেল করা PET ব্যবহার করে প্লাস্টিক উৎপাদনের চাইতে, নতুন PET ব্যবহার করে প্লাস্টিক তৈরী করা অনেক বেশী সহজ এবং কম খরচে করা যায়। যার ফলে বিজ্ঞানীরা প্লাস্টিক রিসাইকেলের জন্য আরও কার্যকরী পদ্ধতির প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। যা PET কে আরও কার্যকরভাবে তার গাঠনিক উপাদানে পরিণত করবে। যা রিসাইক্লিং প্লান্টগুলোতে কোনো ডাই বা রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহার না করে বর্জ্য PET থেকে  আরও উন্নতমানের প্রোডাক্ট উৎপাদনের পথকে সহজ করে দিবে। আর এভাবে প্লাস্টিক রিসাইকেল করা গেলে প্লাস্টিক মেল্টিং এর ফলে যেসব পরিবেশগত সমস্যার উদ্ভব হতো তা থেকেও রেহাই পাওয়া যাবে। বর্তমানে প্লাস্টিক মেল্টিং এর বিকল্প হিসেবে রিসাইকেল প্লান্ট গুলোতে কিছু এনজাইমের ব্যবহার শুরু হয়েছে, যা প্লাস্টিক এর গাঠনিক উপাদানের মধ্যকার বন্ধনকে টার্গেট করে এবং ভেঙে দেয়। এনজাইম ব্যবহারের সূবিধা হলো, এটি খুব নিম্ন তাপমাত্রায় কাজ করে এবং নির্দিষ্ট এনজাইম নির্দিষ্ট ধরনের প্লাস্টিক কে রিসাইকেল করে।
বিস্ময়কর ভাবে বিজ্ঞানীরা কিছু ব্যাকটেরিয়াতে এ ধরনের এনজাইমের খোঁজ পান। এ সুপার এনজাইম সৃষ্টির যাত্রা শুরু হয় জাপানের একদল গবেষকের হাত ধরে। ২০১৬ সালে তারা জাপানের একটি রিসাইক্লিং কারখানার বর্জ্যে Ideonella sakaiensis নামক একটি প্লাস্টিক খেকো ব্যাকটেরিয়ার সন্ধান পান। এ ব্যাকটেরিয়ায় PETase নামক এমন একটি এনজাইম রয়েছে যেটি প্লাস্টিক বোতল ও পোশাক শিল্পে ব্যবহৃত কিছু কমন প্লাস্টিককে ভেঙে তার বিল্ডিং ব্লক মনোমারে পরিণত করে রিসাইক্লিং এ সহায়তা করে।
সম্প্রতি ব্রিটিশ গবেষক ও University of Portsmouth এর Centre for Enzyme Innovation (CEI) এর পরিচালক John McGeehan ও তার দল PETase এনজাইম নিয়ে কাজ করেন। তারা ব্যাকটেরিয়াটির জিনোম বিশ্লেষণ করে PETase এনজাইমের গঠন বের করেন, ব্যাকটেরিয়াটি কোন প্রক্রিয়ায় এই এনজাইম ব্যবহার করে প্লাস্টিক কে ভেঙে দেয় তা জানার চেষ্টা করেন। তার দল এক্স রে ক্রিস্টালোগ্রাফি ও ডায়মন্ড লাইট সোর্স ব্যবহার করে এনজাইমটির হাই রেজুলেশন গঠন বের করেন এবং এনজাইমটি যেসব প্রোটিন দিয়ে তৈরী সেগুলো ল্যাবরেটরী তে কৃত্রিম ভাবে তৈরী করা যায় কিনা চেষ্টা করেন। এনজাইমটির গঠন ব্যবহার করে গবেষকদল এনজাইমটির প্রোটিন সিকোয়েন্সে পরিবর্তন আনেন ও এনজাইমটির আরও উন্নত সংস্করণ বের করেন, যা ২০% বেশী কার্যকরী এবং প্লাস্টিক রিসাইকেল সমস্যার সমাধানের সম্ভাবনা কয়েক গুন বাড়িয়ে দেয়।
এই জাপানিজ ব্যাকটেরিয়া নিয়ে কাজ করার সময় গবেষকগণ দুর্ঘটনাক্রমে দ্বিতীয় আরেকটি এনজাইমের সন্ধান পান, এনজাইমটি হলো METase। গবেষকরা মিউট্যান্ট PETase ও METase এনজাইমের সমন্বয়ে সৃষ্ট এনজাইম ককটেল প্রয়োগ করে দেখতে পান প্লাস্টিক আগের চাইতে আরও ছয় গুণ গতিতে ভেঙে মনোমারে পরিণত হচ্ছে। PETase ও METase এর সমন্বয়েই তৈরী এই এনজাইম ককটেলই হলো সুপার এনজাইম।

(PETase ও METase এনজাইমের সমন্বয়ে সৃষ্ট এনজাইম ককটেল ; সোর্সঃ University of Pourtsmith)

এছাড়াও এ সুপার এনজাইম polyethylenefuranoate (PEF) নামক আরও একধরনের প্লাস্টিক রিসাইকেলে খুব কার্যকরী।
দিনদিন আমাদের পৃথিবীতে বর্জ্য প্লাস্টিকের পরিমাণ বেড়ে যাচ্ছে, ধারণা করা হচ্ছে ২০৫০ সালের মধ্যে সমুদ্রে মাছের চাইতে প্লাস্টিকের পরিমাণই হবে বেশী। প্লাস্টিক মানবজাতির বিলুপ্তির অন্যতম কারণও হয়ে উঠতে পারে। তাই প্লাস্টিক রিসাইকেলে খরচ কমিয়ে আনা এখন সময়ের দাবি। এ ধরনের আবিস্কারের ফলে এমনও সময় আসবে যখন রিসাইকেল করা প্লাস্টিক নতুন প্লাস্টিকের সাথে টেক্কা দিবে। প্লাস্টিক রিসাইকেলের খরচ আরও কমে যাবে এবং বিভিন্ন শিল্পকারখানা রিসাইকলকৃত প্লাস্টিক ব্যবহারে আরও আগ্রহী হবে। যাহোক বিজ্ঞানীরা যদি ১০০% কার্যকরী এনজাইম কিংবা ১০০% প্লাস্টিক খেকো ব্যাকটেরিয়ার সন্ধানও পান, তবুও প্লাস্টিক সমস্যার সমাধান হবে না, যতদিন পর্যন্ত না আমরা প্লাস্টিকের ব্যবহার কমিয়ে আনছি।

তথ্যসূত্রঃ
[১]https://www.sciencemag.org/news/2021/07/could-plastic-eating-microbes-take-bite-out-recycling-problem?utm_campaign=SciMag&utm_source=Social&utm_medium=Facebook
[২] https://youtu.be/oNkk3JPYd6s



2 Comments

It’s all about friendly conversation here. I'd love to hear your thoughts. Be sure to check back again because I do make every effort to reply to your commnts here. Keep it polite and on topic. You may need to refresh before your comment shows up!

  1. Good job. I am also a Biotechnologist and a blogger. You are really inspiring.

    ReplyDelete
    Replies
    1. Thanks dear! Please follow the upcoming articles!

      Delete
Previous Post Next Post