তীর-ধনুকের কার্যপ্রণালী, তার সাথে জীবনের সম্পর্ক, জীবনের নির্যাস খুঁজে ফেরা, সর্বোপরি আমাদের জীবনের লক্ষ্য ও ছুটন্ত তীরের মতোই তার পেছনে ছুটে চলার মর্মার্থ নিয়ে পাওলো কোয়েলহোর বেস্টসেলার বই 'দ্যা আর্চার'।
কিংবদন্তি তীরন্দাজ 'টেটসুয়া', পেশায় একজন কাঠমিস্ত্রী, তার নিজের শহরের কেউই জানেন না তিনি পৃথিবীর সেরা তীরন্দাজ। একদিন শহরে আগমন ঘটে এক আগন্তুকের, তিনি এসেই এক ছেলের কাছে খোঁজ নেন টেটসুয়া কোথায় থাকেন। আগন্তুক জানান, সে এতদিনের চর্চার পর যে নিখুঁত হতে পেরেছে তা প্রমাণ করতে এসেছে, সে টেটসুয়ার সুনামের ইতি টানতে চায়। যথারীতি টেটসুয়ার সাথে তার দেখা হয়, সে চল্লিশ মিটার দূর থেকে একটি চেরী ফলকে দু টুকরো করার মাধ্যমে তার নিপুণতার পরিচয় দেয়, এরপর টেটসুয়ার দিকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেয়। টেটসুয়া তার ধনুক বের করে, আগন্তুকের কাছ থেকে তীর নিয়ে দোদুল্যমান ক্ষয়িষ্ণু এক দড়ির সেতুর উপর দাঁড়ায়, এবং বিশ মিটার দূরের এক পিচ ফলকে তাক করে ছিন্ন করে। আবার আগন্তুককে বলেন একইভাবে সেতুর উপর দাড়িয়ে বিশ মিটার দূরের পিচ ফলকে ছিন্ন করতে। কিন্তু এবারে আগন্তুক পারলেন না, তিনি বিদায় নিলেন।
এতক্ষণের ঘটনায় ছেলেটি ছিল আগন্তুক আর টেটসুয়ার তীরন্দাজির প্রত্যক্ষদর্শী। ফেরার পথে সে টেটসুয়ার কাছে নানা বিষয় জানতে চাইল। টেটসুয়া ছেলেটিকে বলল, 'প্রথমে কারও কথা শুনে তাকে বিচার না করে, তাকে আমাদের সম্মান করা উচিত'। তারপর পাহাড়ি পথ ধরে নামতে নামতে টেটসুয়া ছেলেটির কাছে তুলে ধরল তীর-ধনুকের মূলনীতি ও তা কিভাবে আমাদের জীবনে কাজে লাগানো যায়। যা এ বইয়ে তুলে ধরা হয়েছে ছোট ছোট তেরোটি পর্বের মাধ্যমে।
পর্ব-১ঃ মিত্র (সমমনা ব্যাক্তি)
কোনোকিছু শুরু করার আগে মিত্রদের তালাশ করতে বলা হয়েছে। মিত্র হলো তারা, যারা আপনার মতো একই কাজে আগ্রহী, একইভাবে চিন্তা করে, ভুল করার ভয়ে কোনো কাজে নামতে ভীত নন, বৃথা সময় নষ্ট করেন না, সিদ্ধান্ত নিয়ে দ্রুত কাজে নেমে পড়েন, বাকি সবার মতো চিন্তা করেন না, ব্যর্থতা থেকে শিক্ষা নেন, যারা অনিশ্চয়তাকে পছন্দ করেন, তাদের চোখেমুখে থাকে আনন্দের ঝিলিক। কারণ তাদের সাথেই আপনি আনন্দ-উৎসাহের সাথে লক্ষ্য অর্জন করতে পারবেন।
পর্ব-২ঃ ধনুক (জীবন)
ধনুক যেমন সবসময় তীরন্দাজের সাথে থাকে, জীবনও একই। ধনুকের কোনো চেতনা নেই, একইভাবে চিন্তা-চেতনা বাদ দিয়ে নিজ ইচ্ছে অনুযায়ী জীবন পরিচালনা করতে হবে। ধনুক নমনীয় জিনিস, কিন্তু নমনীয়তার ও সীমা আছে। তাই নমনীয়তা মেনে জীবনের সাথে ঐকতানে চলতে হবে।
পর্ব-৩ঃ তীর (ইচ্ছে)
তীর হলো ইচ্ছের প্রতীক। কোনো কাজ করার আগে আমাদের ইচ্ছে হতে হবে স্ফটিকের মতো স্বচ্ছ, সরল ও ভারসাম্যপূর্ণ। ইচ্ছে লক্ষ্যভেদে ব্যর্থ হলে তা থেকে আমরা শিখতে পারব, অনুপ্রাণিত হতে পারব।
পর্ব-৪ঃ নিশানা (লক্ষ্য)
নিশানা হলো সেই লক্ষ্য, যেখানে আপনাকে পৌছাতে হবে। লক্ষ্য আপনাকেই বেছে নিতে হবে, এর সামনে দাড়াতে হবে, একে সম্মান করতে হবে, মানসিকভাবে নৈকট্য তৈরী করতে হবে, বন্ধু ভাবতে হবে, আর ফলাফল যা আসে তা মেনে নিতে প্রস্তুত থাকতে হবে। যেমনভাবে ইচ্ছে খুঁজে লক্ষ্য কে, তেমনি লক্ষ্য খুঁজে ইচ্ছে কে।
পর্ব-৫ঃ অঙ্গভঙ্গি
যখন আমরা জীবন, ইচ্ছে, লক্ষ্য বুঝতে পারব, তখন তার দিকে ধেয়ে যেতেই আমাদের মাঝে প্রশান্তি ও আভিজাত্য চলে আসবে। জীবনে সৌন্দর্য উদঘাটন করতে হবে, সৌন্দর্য কোনো ভাসাভাসা বিষয় নয়। বরফকে যেমন সুন্দর দেখায় কেবল একটি রঙ এর বলে, কিংবা সাগরকে সুন্দর মনে হয় এর উপরিভাগ সমতল বলে, ঠিক একইভাবে সাধারণ ও পরিমিত অঙ্গভঙ্গির মাধ্যমে নিজেদের গুণাবলির ব্যাপারে সজ্ঞান হতে হবে।
পর্ব-৬ঃ কেমন করে তীর ধরতে হয়
নিখুঁত, সরল, তীক্ষ্ণ, অটল, সুক্ষ্ম ইচ্ছের মাধ্যমে নিজের সীমাবদ্ধতা গুলো জেনে, তা থেকে শিক্ষা নিয়ে নিশানা তথা লক্ষ্য অর্জনে সচেষ্ট হতে হবে।
পর্ব-৭ঃ কেমন করে ধরতে হয় ধনুক
এ পর্বে মিত্র তথা সমমনা ব্যক্তিদের পরোক্ষ ভূমিকায় কিভাবে আমরা জীবনে এগিয়ে যেতে পারি তা তুলে ধরা হয়েছে।
পর্ব-৮ঃ কেমন করে টান দিবে ধনুকের ছিলায়
একজন সুরকার যেভাবে একগুচ্ছ দূর্বোধ্য সংগীত নোটকে শব্দ ও ছন্দে পরিণত করে, ঠিক একইভাবে নিজের জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার সহয়তায় লক্ষ্য অর্জনে এগিয়ে যেতে হবে।
পর্ব-৯ঃ কেমন করে লক্ষ্যের দিকে নজর দিতে হয়
কিভাবে ভালোবাসার মাধ্যমে লক্ষ্যে পৌছানো যায়, কিভাবে অসম্পূর্ণতা কে পরিপূর্ণতায় রূপান্তরিত করা যায়, কিভাবে বাজে মূহুর্তগুলোতে নিজেকে খুঁজে নেওয়া যায়, কিভাবে ভালো মূহুর্তগুলোতে অর্ন্তপ্রশান্তি খুঁজে নেওয়া যায়, কিভাবে ভয় বা আনন্দ কোনো কিছুতেই না থেমে জীবনকে এগিয়ে নিয়ে উপভোগ করতে হয় তা তুলে ধরা হয়েছে।
পর্ব-১০ঃ তীর নিক্ষেপের মুহুর্ত
আত্মার সন্তুষ্টির সাথে দারুণ সুক্ষ্মতায় ইচ্ছেকে নিক্ষেপ করতে হবে লক্ষ্যের প্রতি। আর ইচ্ছেকে অনুসরণ করতে দিতে হবে এর নিয়তিকে।
পর্ব-১১ঃ পুনরাবৃত্তি
কামারের বারবার হাতুড়ি মারার খেলায় প্রতিবার সমান প্রখরতা থাকে না, বায়ুকল নিয়ন্ত্রিত হয় বায়ু দ্বারা, একে দিকবদল করতে হয় প্রয়োজনমতো, একইভাবে প্রথমবার করার মাধ্যমে কোনো কাজে নিপুণতা আসে না, তাই ভুল হলে বার বার চেষ্টা চালিয়ে যেতে হয়।
পর্ব-১২ঃ কেমন করে লক্ষ্য করতে হয় তীরের গতিপথ
কৌশল ও সুক্ষ্মতার সাথে নিজের গতিপথ অনুসরণ করলে লক্ষ্য অর্জন করা যায়, নির্ভেজাল অনুভূতি পাওয়া যায়।
পর্ব-১৩ঃ ধনুক, তীর আর নিশানা ছাড়া তীরন্দাজ
যখন কোনো উপকরণই থাকে না, তখন তীরন্দাজ কে অনুসরণ করতে হয় স্বভাবগত প্রবৃত্তির। পড়া শিখতে শুরু করার এক পর্যায়ে একজন ছাত্র যেমন অক্ষরের বন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে নিজেই বিভিন্ন শব্দ তৈরি করতে পারে, একইভাবে আনন্দ আর উদ্যম, সুক্ষ্মতা ও ভুলের, কৌশল ও স্বভাবগত প্রবৃত্তির সহয়তায় এগিয়ে চলে মানুষ৷
বইঃ 'দ্য আর্চার'
লেখকঃ পাওলো কোয়েলহো
অনুবাদঃ শেহজাদ আমান