শিরোনামটি দেখার পর হয়তো আপনার মনে খটকা লাগতে পারে, পৃথিবীর বুকে মঙ্গল! এ আবার কি? সত্যিই কি পৃথিবীতে মঙ্গলের মতো কিছু পাওয়া গেছে?
মানুষ বুদ্ধিমান ও কৌতূহলোদ্দীপক এক প্রাণী। প্রথমে সে তার বাহারি বুদ্ধি ও জ্ঞান কে কাজে লাগিয়ে গড়ে তুলেছে সভ্যতা, করেছে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উত্তরোত্তর উন্নতি সাধন। এত সব উদ্ভাবনের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়াস্বরূপ হয়েছে পৃথিবীর আবহাওয়া ও জলবায়ুর ব্যাপক ক্ষতি। দিনদিন বাস অযোগ্য হয়ে উঠছে আমাদের পৃথিবী। তাই বিজ্ঞানীরা অনেক দিন ধরেই স্থানান্তরের জন্য দ্বিতীয় পৃথিবীর খোঁজ করছেন। মূল উদ্দেশ্য হলো জলবায়ু পরিবর্তনসহ নানা সমস্যায় জর্জরিত পৃথিবীর মনুষ্য প্রজাতিকে টিকিয়ে রাখার জন্য বিকল্প কোনো আবাসস্থল গড়ে তোলা। বর্তমানে স্থানান্তরিত হওয়ার জন্য সম্ভাবনা হিসেবে আছে লালগ্রহ মঙ্গল।মঙ্গলে বসতি স্থাপনের জন্য নিরলস গবেষণা করে যাচ্ছেন বিজ্ঞানীরা, যদিও এখনো মঙ্গলের বুকে পা দিতে পারেনি মানুষ জাতি। ২০২০ সালে নাসা তাদের পারসিভিয়ারেন্স রোভার (Perseverance Rover) নামক একটি রোবটযান মঙ্গলের উদ্দেশ্যে প্রেরণ করে।এটি ২০২১ সালের ১৮ ই ফ্রেব্রুয়ারি মঙ্গলের জেজেরো ক্রেটর (Jezero Crator) নামক স্থানে অবতরণ করে। সর্বপ্রথম ২০০৭ সালে বিজ্ঞানীরা উপগ্রহ প্রেরিত ছবি পর্যবেক্ষণ করে এর অস্তিত্ব সম্পর্কে নিশ্চিত হয়েছিলেন। মঙ্গলের বুকে পা দেওয়ার পর পারসিভিয়ারেন্স সেই জেযেরো ক্রেটর ও এর আশেপাশের ধুলাবালির মধ্যে থেকে নমুনা সংগ্রহ করে, বিষদ বিশ্লেষণ করে এর মাটি, পরিবেশ ইত্যাদি সম্পর্কে তথ্য প্রদান করে।
(মঙ্গল গ্রহে পাঠানো পার্সিভিয়ারেন্স রোভার নামক রোবটযান; নাসা)
(মঙ্গলের বুকে Jezero Crator এর অবস্থান; লাইভ সায়েন্স.কম)
কেন সালদা হ্রদকে মঙ্গলের সাথে তুলনা করা হয়?
মঙ্গল গ্রহের উপরিভাগের তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ এবং মাটির গঠন পর্যালোচনার পাশাপাশি সালদা হ্রদ নিয়েও চলেছে ব্যপক গবেষণা। ২০১৯ সালে যুক্তরাষ্ট্র ও তুরস্কের একদল বিজ্ঞানী সালদা লেক নিয়ে কাজ করেন। তাদের সংগৃহীত সালদা লেক সম্পর্কিত তথ্যের সাথে মঙ্গলের জেজেরো ক্রেটর ও এর আশেপাশের পরিবেশের মিল পাওয়া যাচ্ছে বলে জানান নাসার বিজ্ঞানীরা। এছাড়া নাসার রোভার পারসিভারেন্সের পাঠানো ছবির সাথে মিল পাওয়া গেছে এই হ্রদের মাটির, মিল আছে মাটির গঠনেও। মিল রয়েছে হ্রদের খনিজ পদার্থের সাথে মঙ্গলপৃষ্ঠে থাকা খনিজেরও। বিজ্ঞানীরা আশা করছেন, সালদা হ্রদের মাটি ও খনিজের সঙ্গে মঙ্গলের মাটি ও খনিজের মিলের বিষয়টি মঙ্গলে প্রাণের অস্তিত্ব সম্পর্কে ইঙ্গিত হতে পারে৷ হয়তো একই ধরনের অণুজীব রয়েছে দুই স্থানেই। তারা আরো মনে করছেন, হ্রদের তলদেশে থাকা পাথর কিংবা যদি তলদেশ থেকে পাওয়া ফসিল পর্যবেক্ষণ করা যায় তাহলে তা থেকে মিলতে পারে আরো অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য। এ কারণে সালদা এবং মঙ্গলের মাটি ও খনিজের নমুনা গবেষণায় খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। তাই মোট ১০টি টিউবে করে মঙ্গলপৃষ্ঠের নমুনা সংগ্রহ করবে পারসেভারেন্স। এরপর সেগুলো পাঠানো হবে পৃথিবীতে। দুই গ্রহের মাটি এবং খনিজ পদার্থের মিল মঙ্গলে প্রাণের অস্তিত্ব সম্পর্কে আশাবাদী করলেও বিজ্ঞানীরা বলছেন, বিষয়টি সম্পর্কে নিশ্চিত হতে হয়তো লেগে যেতে পারে ২০৩১ সাল পর্যন্ত।
(Salda Lake ও Jezero Crator এর তুলনামূলক চিত্র;নাসা)
সালদা হ্রদের অবস্থান
পানির রঙের সাথে মিল থাকার কারণে সারাবিশ্বের ভ্রমণপিপাসু পর্যটকদের কাছে তুরস্কের মালদ্বীপ বা দ্বিতীয় মালদ্বীপ হিসেবে খ্যাত এই সালদা হ্রদ। এটি তুরস্কের দক্ষিণ-পশ্চিম সীমান্তের Burdur প্রদেশের Yeşilova জেলায় অবস্থিত। এটি Burdur প্রদেশ থেকে পশ্চিমে প্রায় পঞ্চাশ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত একধরনের মাঝারি আকারের ক্রেটর(crater) হ্রদ। সাধারণত আগ্নেয়গিরির অগ্নুৎপাত থেকে গর্তের মতো হয়ে যেসব হ্রদের জন্ম হয় তাদেরকে ক্রেটর হ্রদ বলে।প্রায় ২ মিলিয়ন বছর পূর্বে জন্ম নেয়া সাদা বালুচর বিশিষ্ট এই হ্রদের আয়তন প্রায় ৪৫ বর্গকিলোমিটার এবং গভীরতা প্রায় ১৮৫ মিটার। এটি তুরস্কের তৃতীয় গভীরতম হ্রদ।
(জিওলজিক্যাল মানচিত্রটি Salda Lake এর অবস্থান; রিসার্চগেট.নেট)
সালদা হ্রদের পরিবেশ ও বাস্তুতান্ত্রিক বৈচিত্র্য
চারদিকে ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চল দ্বারা পরিবেষ্টিত সালদা হ্রদের জলবায়ু নাতিশীতোষ্ণ ধরনের। উষ্ণতম মাস আগস্ট, শীতলতম মাস জানুয়ারী এবং সবচেয়ে বেশি বৃষ্টিপাত হয় জুলাই মাসে। হ্রদের পানিতে ম্যাগনেসিয়াম, সোডিয়াম ইত্যাদি ধাতু ও কাদামাটির উপস্থিতির কারণে কিছু চর্মরোগ ও ব্রণের চিকিৎসায় ফলদায়ক বলে মনে করেন অনেকে। পাইনগাছ দিয়ে পরিবেষ্টিত বন ও দেখা যায় এ অঞ্চলে। বনে পার্টরিজ(Partridge),খরগোশ, শেয়াল, বন্য শুকর এবং হ্রদে বন্য হাঁস দেখা যায়। বিভিন্ন ধরনের কার্প মাছ(Carp), গ্রাস ফিস(Grass fish), সালদা শৈবাল(Salda algae), মাড ফিস(Mud fish), সাপ এবং নিম্নভূমির ব্যাঙ বাস করে এ অঞ্চলে। গ্রাস ফিস হলো Burdur প্রদেশের এন্ডেমিক মাছ। এছাড়া হ্রদের পানি ক্ষারীয় প্রকৃতির এবং পানিতে বিভিন্ন পুষ্টি উপাদানের উপস্থিতি কম দেখা যায়।মাটিতে খুব কম পরিমাণে নাইট্রোজেন ও ফসফরাসের উপস্থিতি পাওয়া যায়। এখানকার সবুজ উদ্ভিদে ক্লোরোফিলের ঘনমাত্রা কম পাওয়া যায়।
(সালদা হ্রদের নয়নাভিরাম দৃশ্য; ডেইলি সাবাহ)
দ্বিতীয় মালদ্বীপ কিংবা পৃথিবীর বুকে এক টুকরো মঙ্গল এরূপ খ্যাতি লাভ করার পর সারাবিশ্ব থেকে পর্যটকেরা এই হ্রদ দেখতে ভিড় জমায় প্রতিবছর। উপর্যপুরি পর্যটকের চাপে এই হ্রদের পানি দূষিত হচ্ছে, পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে, বাস্তুতন্ত্রের ক্ষতি হচ্ছে। সম্প্রতি একটি স্থানীয় পরিবেশবাদী সংস্থা তুরস্ক সরকারের কাছে এই হ্রদের উপর থেকে পর্যটন সূবিধা তুলে নেওয়ার দাবি জানিয়েছে।