শিশুদের ক্যান্সারঃ যা জানতে হবে ও জানাতে হবে!

মাত্র পাঁচ বছরের হাসি-খুশি ও প্রাণবন্ত ছেলে মাহাদী। কথা বললে মুখে যেন খই ফুটে। চোখের কোটরে যেন পুরো একটি বিল ঢুকে আছে, পানিতে ভরপুর। হাসলে মনে হয় বিলের জলে ঢেউ বয়ে যাচ্ছে। মা-বাবার কত স্বপ্ন ও আশা-ভরসার প্রতীক সে। কিন্তু কয়েকদিন ধরে মাহাদীর রোজ রাতে পালা করে জ্বর আসে, খাবারের প্রতি অরুচি দেখা দেয়, দেহের ওজন কমতে থাকে, সে দিনদিন রোগা ও প্যাকাটে হয়ে যায়। উদ্বিগ্ন মা-বাবা নিকটস্থ ডাক্তারের কাছে যান, নিয়মিত ওষুধ সেবনের পরও তার কোনো উন্নতি দেখা যায় না। উপরন্তু তার মাথা ঘোরানো, শরীর ফ্যাকাশে হয়ে যাওয়া, চামড়ায় লাল ছোপ ছোপ দাগের মতো লক্ষণ দেখা যায়। অগত্যা বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের কাছে যাওয়ার পর তার পরিবার জানতে পারে তার মরণব্যাধি ক্যান্সার হয়েছে। 


শৈশব ক্যান্সার কি?
ক্যান্সার হলো অনিয়ন্ত্রিত কোষ বিভাজন সংক্রান্ত রোগসমূহের সমষ্টি। প্রাথমিক অবস্থায় এ রোগ সহজে ধরা পড়ে না, তাই সময়োপযোগী চিকিৎসা নেওয়া সম্ভব হয় না। যদিও ক্যান্সার সারানোর জন্য বিভিন্ন ধরনের চিকিৎসা পদ্ধতি প্রয়োগ করা হয়, কিন্তু এখনও পর্যন্ত ক্যান্সারের চিকিৎসায় পুরোপুরি কার্যকর কোনও ওষুধ বা চিকিৎসা পদ্ধতি আবিষ্কৃত হয় নি। এ কারণে ক্যান্সারকে মরণব্যাধি বলা হয়। প্রাথমিক অবস্থায় রোগ নির্ণয় করা গেলে এই রোগ সারানোর সম্ভাবনা অনেকাংশ বেড়ে যায়। আর ক্যান্সার যখন শিশুদের (জন্মের পর থেকে ১৪ বছর) হয় তখন তাকে চাইল্ডহুড ক্যান্সার বা শিশুদের ক্যান্সার বলে।

আগেভাগে যা খেয়াল রাখতে হবে 

শিশুরা সাধারণত রোগ সম্পর্কে সচেতন থাকে না এবং বেশিরভাগ সময় তাদের কেমন লাগছে তা তারা বুঝতে ও বুঝাতে পারে না। তাই বাবা-মা কে এসব বিষয়ে খেয়াল রাখতে হবে। সাধারণত এক থেকে পাঁচ বছর বয়সী শিশুদের ক্যান্সার হতে বেশি দেখা যায়। যদিও শিশুদের ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার হার খুবই কম। বিশ্বে ক্যান্সার আক্রান্তদের মধ্যে ০.৫% থেকে ৪.৬% আক্রান্তরা শিশু। তবে প্রাপ্ত বয়স্কদের তুলনায় শিশুদের ক্যান্সার কিছুটা ভিন্ন। শিশুদের মধ্যে সাধারণত লিউকেমিয়া বা রক্তের ক্যান্সার বেশি হয়। ক্যান্সার আক্রান্ত শিশুদের মধ্যে এক-তৃতীয়াংশই লিউকেমিয়ায় আক্রান্ত। এছাড়া ক্যান্সারের কিছু ধরন শুধুমাত্র শিশুদেরই হয়ে থাকে। যেমনঃ নিউরোব্লাস্টোমা, নেফ্রোব্লাস্টোমা, মেডুলোব্লাস্টোমা, এবং রেটিনোব্লাস্টোমা, লিউকোমা ইত্যাদি। 

শৈশব ক্যান্সারের কারণ
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, বিশেষ কোনো কারণ না থাকলেও
খাবারে টক্সিনের উপস্থিতি, পরিবেশগত সমস্যা, জীনগত কারণে, ক্ষতিকর রশ্মি বা বিকিরণের সংস্পর্শে আসলে শিশুরা ক্যান্সারে আক্রান্ত হতে পারে। এছাড়া কিছু গবেষণায় দেখা গিয়েছে, হেপাটাইটিস বি, হিউম্যান হার্পিস এবং এইচআইভি ভাইরাসের আক্রমণ শিশুদের ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়। [১]

শৈশব ক্যান্সারের লক্ষণ
ক্যান্সারে অন্যান্য রোগের মতোই সাধারণ কিছু লক্ষণ থাকে। কিন্তু শিশুদের মধ্যে নিম্নোক্ত লক্ষণের এক বা একাধিক উপস্থিত থাকলে ও দীর্ঘদিনে সুস্থ না হলে দ্রুত বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া উচিত।
১)শরীর অনেকদিন ধরে ব্যাথা থাকলে ও ব্যাথা সেরে না ওঠলে
২)শরীরের কোন অংশ হঠাৎ ফুলে গেলে এবং দীর্ঘদিনেও ভাল না হলে
৩)নিয়মিত জ্বর আসলে, জ্বর ভাল না হলে
৪) শরীর ফ্যাকাশে হয়ে গেলে
৫)দীর্ঘদিন ধরে মাথাব্যথা বা মাথা ঘোরানোর মতো সমস্যা থাকলে
৬)খাবারে অরুচি ও ওজন কমে গেলে
৭)শরীরের কোন অংশ থেকে হঠাৎ করে অস্বাভাবিকভাবে রক্তক্ষরণ হলে
৮)চামড়ায় কালো বা লাল ছোপ ছোপ দাগ দেখা গেলে ইত্যাদি।

শৈশব ক্যান্সার নির্ণয়
বেশির ভাগ ক্ষেত্রে শিশুদের ক্যান্সার নিরাময়যোগ্য। ক্যান্সার শনাক্ত করা গেলে ও উন্নত চিকিৎসা পেলে প্রায় ৮০% রোগী সেরে ওঠেন। কিন্তু মাত্র ২০% রোগীই উন্নত চিকিৎসার সুযোগ পান। ক্যান্সার চিকিৎসায়, প্রথমে এক বা একাধিক লক্ষণের উপস্থিতি দেখে রোগ সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার জন্য ডাক্তার রোগীকে কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে দেন।[২] তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলোঃ
১)রক্ত পরীক্ষা
২)বায়োপসি
২)বোন ম্যারো পরীক্ষা
৩)প্যাথোলজি পরীক্ষা
৪)আল্ট্রাসনোগ্রাফি
৫)সিটি স্ক্যান (CT scan)
৬)এমআরআই (MRI) ইত্যাদি।

শৈশব ক্যান্সারের চিকিৎসা
ক্যান্সারের চিকিৎসা বিভিন্নভাবে করা হয়। একজন ক্যান্সার আক্রান্ত শিশুকে কি ধরনের চিকিৎসা দেওয়া হবে তা নির্ভর করে তার কি ধরনের ক্যান্সার হয়েছে এবং কোন পর্যায়ে আছে তার উপর। ক্যান্সার নিরাময়ে প্রচলিত কিছু চিকিৎসা পদ্ধতি হলোঃ অস্ত্রোপ্রচার, কেমোথেরাপি, রেডিওথেরাপি, ইমিউনোথেরাপি, স্টেম কোষ প্রতিস্থাপন।[৩]

ক্যান্সার চিকিৎসায় সৃষ্ট পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া
ক্যান্সারের চিকিৎসা চলাকালীন অবস্থায় রোগীদের মধ্যে কিছু পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া দেখা যায়। ক্যামোথেরাপি, রেডিওথেরাপি দেওয়ার সময় ক্যান্সার আক্রান্ত কোষের সাথে শরীরের জন্য উপকারী কোষও ধ্বংস হয়ে যায়। এক্ষেত্রে ডায়রিয়া, শরীর দূর্বল হয়ে যাওয়া, চুল ঝরে পড়া ইত্যাদি পার্শ্ব প্রতিক্রিয়ামূলক লক্ষণ দেখা যায়। অনেক ক্যান্সার আক্রান্ত রোগী ভাল হয়ে যাওয়ার পরও তার দীর্ঘস্থায়ী লক্ষণ যেমন, পুনরায় ক্যান্সার আক্রান্ত হওয়া, মানসিক সমস্যা, হৃদরোগ, হরমোনজনিত সমস্যা, পরবর্তীতে সন্তান জন্মদানজনিত সমস্যা ইত্যাদি দেখা দেয়।[৪]

ক্যান্সার সচেতনতায় বিভিন্ন সংস্থার ভূমিকা ও তহবিল সংগ্রহের প্রয়োজনীয়তা

যদিও ক্যান্সার নিরাময়যোগ্য, তবে প্রচলিত কিছু মিথ যে কাউকেই বাধ্য করে ক্যান্সার সম্পর্কে সচেতন হতে। আর এটিই বিভিন্ন সংস্থার জন্য সবচেয়ে বড় সুযোগ হতে পারে। ক্যান্সার সচেতনতায় নিয়োজিত বিভিন্ন সংস্থার জন্য অন্যতম চ্যালেঞ্জিং বিষয় হলো, বাংলাদেশের কোন কোন অঞ্চলে ক্যান্সার বেশী হয় ও কি ধরনের ক্যান্সার হয় তার পরিসংখ্যান বের করা। এছাড়া সরকারি ও বেসরকারি সহায়তায় সেসব অঞ্চলে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকের শিক্ষার্থীদের মাঝে সতর্কতামূলক কর্মসূচি করা, প্রাথমিক বিদ্যালয়ে অভিভাবক সমাবেশ করে অভিভাবকদের জানানো, প্রতিকী নাটক, সভা, সমাবেশের মাধ্যমে সাধারণ মানুষকে জানানোর মাধ্যমে সচেতনতা বৃদ্ধি করা যায়। টিশার্ট, ব্যাগ, দেয়ালে, পোস্টার ছাপিয়ে ক্যান্সার সচেতনতামূলক বাক্য লিখে সাধারণ মানুষের মাঝে বিতরণ করেও সচেতন করা যায়। বর্তমানের জেনারেশন এর সন্তানদের নিয়ে অভিভাবকের অভিযোগ হলো তারা ফোনে সারাদিন গেইম খেলে, তাই ক্যান্সার নিয়ে শিক্ষামূলক গেইম বানানোর মাধ্যমে তাদের সচেতন করা যায়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও গণমাধ্যম আমাদের দৈনন্দিন জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপকরণ। তাই এসব মাধ্যমে সচেতনতামূলক সেশন, ইভেন্ট পরিচালনার মাধ্যমেও মানুষকে সচেতন করা যায়। মানুষ সচেতন হলেই, ক্যান্সারের ভয়াবহতা বুঝবে। অন্যের কষ্টে এগিয়ে আসবে। এসব সংস্থা তহবিল সংগ্রহের মাধ্যমে ক্যান্সার আক্রান্ত শিশুদের চিকিৎসার ব্যায়ভার বহনে সাহায্য করতে পারে, ক্যান্সার আক্রান্ত শিশুদের পড়ালেখা করানোর দায়ভার নিতে পারে।
পরিশেষে, শিশুদের ক্যান্সার ভালো হয়, প্রয়োজন শুধু সচেতন হওয়া ও সচেতনতা ছড়িয়ে দেওয়া।

তথ্যসূত্রঃ
[১]https://www.google.com/amp/s/amp.cancer.org/cancer/leukemia-in-children/causes-risks-prevention/risk-factors.html
[২]https://www.cancer.net/cancer-types/childhood-cancer/diagnosis

[৩]https://www.cancer.gov/types/childhood-cancers
[৪]https://www.cancer.net/navigating-cancer-care/children/late-effects-childhood-cancer




Post a Comment

It’s all about friendly conversation here. I'd love to hear your thoughts. Be sure to check back again because I do make every effort to reply to your commnts here. Keep it polite and on topic. You may need to refresh before your comment shows up!

Previous Post Next Post